কক্সবাজার, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফর, জনসভা হবে জনসমুদ্র

প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার সফরে আসছেন। এসময় জেলায় ২৮ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন তিনি। ১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। একইসঙ্গে ৫৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে।

আগামীকাল বুধবার (৭ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রী মেরিনড্রাইভের উখিয়ার ইনানীতে আন্তর্জাতিক নৌ-মহড়া পরিদর্শন শেষে অংশ নেবেন সৈকতের লাবণী পয়েন্টের শহীদ শেখ কামাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য দলীয় জনসভায়।

প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে কক্সবাজার শহরের অলিগলি থেকে গ্রামের রাস্তাঘাট ছেয়ে গেছে ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড আর তোরণে। চলছে মাইকিংও। ভেন্যুসহ পুরো শহর সমাবেশস্থলে পরিণত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন দলটির নেতা-কর্মীরা।

জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় ৬ লাখ মানুষের সমাগমের লক্ষ্যে কর্মযজ্ঞ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে সফলভাবে বাস্তবায়নে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ শেষ হচ্ছে দোহাজারি থেকে ঘুমধুম রেললাইন সম্প্রসারণ কাজ। একই সময়ে শেষ হবে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পসহ আরও কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে কক্সবাজার।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারে চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ তদারকি করছেন। প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। পর্যটন শিল্প বিকাশে কক্সবাজারকে ঢেলে সাজাতে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চলছে। টেকনাফের সাবরাং, জালিয়ারদিয়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ এবং কক্সবাজার সদরের খুরুস্কুলে পর্যটনের জন্য বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক পর্যটন এলাকা হিসেবে কক্সবাজারের পরিচিতি যেমন বাড়বে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ১ হাজার ৩৮২ দশমিক ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সমাপ্তের পর উদ্বোধনের তালিকায় থাকা উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে আছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রামুতে বিকেএসপি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কক্সবাজারে ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম উন্নয়ন।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কুতুবদিয়ায় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন ও বাহারছড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মাঠ এবং কলাতলী উদ্যান নির্মাণ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের আওতায় জোয়ারিনালা শেখ হাসিনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪ তলা ভবন, আব্দুল মাবুদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় ভবন ও উখিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের আওতায় ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে ৩ তলা বিশিষ্ট আধুনিক বহির্বিভাগ ভবন নির্মাণ। সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতায় জেলার লিংক রোড-লাবণী মোড় সড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ, টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ হাড়িয়াখালী হতে শাহপরীর দ্বীপ অংশ পুনর্নির্মাণ, প্রশস্তকরণ এবং শক্তিশালীকরণ, রামু-ফতেখাঁরকুল-মরিচ্যা জাতীয় মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্থতায় উন্নীতকরণ।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কক্সবাজার টেকনাফস্থ শাহপরীর দ্বীপে হোল্ডার নম্বর-৬৮ এর সি-ডাইক অংশের বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়ন। স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন রামু উপজেলাধীন কলঘর বাজার-রাজারকুল ইউপি সড়কে বাঁকখালী নদীর ওপর ৩৯৯ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ব্রিজ, নবনির্মিত ৬ ইউনিয়ন ভূমি অফিস ভবন, রামু উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ, টেকনাফ উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন সম্প্রসারণ, উখিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ, বিমানবন্দর থেকে নুনিয়ারছড়া সড়ক এবং ৪টি সংযোগ সড়ক আরসিসিকরণ, শহীদ সরণী সড়ক এবং ৩টি সংযোগ সড়ক আরসিসিকরণ, সদর থানা থেকে খুরুশকুল পর্যন্ত আরসিসি সড়ক নির্মাণ, সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত সড়ক এবং ৪টি সংযোগ সড়ক আরসিসিকরণ এবং কক্সবাজার প্রধান সড়ক থেকে খরুশকুল রোড হয়ে তারাবনিয়ারছড়া পর্যন্ত আরসিসি সড়ক নির্মাণ প্রকল্প শেষ হয়েছে।

পাশাপাশি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (২য় পর্যায়) প্রকল্প, এলজিইডির আওতায় কুতুবদিয়ার ধুরুং জিসি মিরাখালী সড়কের ধুরুংঘাটে ১৫৩ দশমিক ২৫ মিটার জেটি এবং আকবর বলি ঘাটে ১৫৩ দশমিক ২৫ মিটার জেটি ও মহেশখালী গোরকঘাটা ঘাটে জেটি নির্মাণ এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিরাপত্তা উন্নতির লক্ষ্যে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদীর তীরের ৬৭/এ, ৬৭, ৬৭/বি এবং ৬৮ পোল্ডার পুনর্মেরামত প্রকল্প।

জানা গেছে, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এর ফলে সমুদ্র ছুঁয়ে ওঠানামা করবে বড় আকারের উড়োজাহাজ। এ প্রকল্পের পরিচালক ইউছুপ ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৪৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী বছরের অক্টোবরে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে। ২০১৭ সালের ৬ মে সম্প্রসারিত রানওয়েতে বিমানের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইসময় কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে ৯ হাজার ফুট থেকে ১২ হাজার ফুটে উন্নীতকরণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই নির্দেশনা অনুসারে ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য আরও ১ হাজার ৭০০ ফুট সম্প্রসারণের কাজ এগিয়ে চলছে। এটি শেষ হলে বৃহদাকার উড়োজাহাজ সমুদ্র ছুঁয়ে এখানে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে রি-ফুয়েলিং সুবিধাও এখানে থাকবে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মোর্তজা হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে আমরা বিমানের শিডিউল বৃদ্ধি করেছি। বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০টি যাত্রীবাহী বিমান ও ৬ থেকে ৮টি কার্গো বিমান ওঠানামা করছে। রাতে বিমান ওঠানামায় বিমানবন্দর প্রায় প্রস্তুত। সমুদ্রগর্ভে আরও লাইটিং সিস্টেম স্থাপনের কাজ চলছে।

মাতারবাড়ি থেকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আগামী ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে আশা করছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু রায়হান সরকার জানান, কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটির ৮৮ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। দু’টি জেটির কাজ শেষ হওয়ায় সেখানে কয়লা নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে। এছাড়াও প্রকল্পের বিভিন্ন অবকাঠামোর কাজ শেষ পর্যায়ে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ৬শ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালের জুনে আরও ৬শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১শ কিলোমিটার রেললাইনের নির্মাণ কাজ ২০২৩ সালের জুন মাস নাগাদ শেষ হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে, ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এই প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ২০২৩ সালের আগস্টের মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল চলাচল শুরু হবে বলে আশা করছি। কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। এর কাজও শেষ পর্যায়ে।

প্রকল্প পরিচালক জানান, কক্সবাজার ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন ভবন। ২৯ একর জমির ওপর রেলস্টেশনটি আয়তন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুট। ভবনটি হবে ছয়তালা। মূলভবনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হবে ঝিনুকাকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। ভবনটিতে থাকবে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কক্ষ, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, যাত্রী লাউঞ্জ, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, তারকামানের হোটেল, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যালয়।

এদিকে জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হবে মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। ২০১৭ সালে কক্সবাজারকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সে অনুযায়ী নানারকম উন্নয়ক কর্মযজ্ঞ চলছে বলেও জানান স্থানীয়রা।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরমেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে সফল করতে ইতোমধ্যে প্রচারণামূলক নানা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ১৪ বছরে কক্সবাজারকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন। সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেলে অপূর্ণতা কিছু থাকবে না। জনসভায় কক্সবাজারবাসীর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান জানানো হবে। জেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে দাওয়াত কার্ড পৌঁছানো হবে।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুর ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, জনসভাকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা ইতোমধ্যে স্টেডিয়াম পরিদর্শন করেছেন। সমাবেশস্থল নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরাও কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। কয়েক লাখ মানুষের অবস্থান নিশ্চিত করতে কক্সবাজার শেখ কামাল স্টেডিয়ামের পশ্চিম একাংশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। জনসভাকে জনসমুদ্রে পরিণত করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

পাঠকের মতামত: